লোকসভায় সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল বা নাগরিকত্ব বিলকে ধ্বনি ভোটে পাশ করতে পেরেছে বিজেপি৷ কিন্তু অসম এবং ত্রিপুরায় এই নিয়ে অশান্তি অব্যাহত৷ এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কে বা কারা প্রস্তাবিত এই আইনের বিরোধী৷ তাদের বিরোধীতার কারণ কী৷ আর্টিকেল ১৪ -এর উল্লেখ করে কংগ্রেস দাবি করেছে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করা যেতে পারে না৷ সাংসদ উত্তাল হয়েছে৷
১. কী আছে এই নাগরিকত্ব বিলে?
প্রথমেই বলে রাখা ভালো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব বিলের সঙ্গে সংশোধিত বিলের বিশেষ তফাত কিছুই নেই৷ বিলে যা আছে, তা যদি ব্যাখ্যা করা যায় তবে বলতে হবে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমানরা যেমন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, অন্যদিকে ওই তিন দেশ থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি, শিখ বা খ্রীস্টানদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হলেন শরণার্থী৷ ভারতের সরকার, প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেবে৷ কারণ, তাঁরা বিপদের মুখে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন৷অন্যদিকে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো হবে, কারণ সীমান্তের ওপার থেকে রোজগার বা বাসস্থান খুঁজে পেতে, কিংবা কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁরা এদেশে এসেছে৷ তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘুরা, যারা গত একবছর ভারতে রয়েছেন বা শেষ ৬ বছর ধরেই এই দেশে রয়েছেন, তারাই নাগরিকত্ব আইনের (বিল আইন হিসেবে পাশ হয়ে যাওয়ার পর) আওতায় নাগরিক হতে পারবেন৷ অন্যদিকে, ওভারসিজ সিটিজেন কার্ডহোল্ডারা (ওসিসি) কোনও অনৈতিক কাজ করলে তাঁদের নথীভুক্তিকরণ বাতিল হতে পারে৷ পুরানো আইনে নাগরিত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৯১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরকে তারিখ ‘কাট অফ’হিসেবে গণ্য করা হত৷ নতুন বিল আইন হিসেবে গৃহীত হলে মার্চের ১৯৭১ সালের মার্চকে ‘কাট অফ হিসেবে দেখা হবে৷
২. অসমে এবং ত্রিপুরায় কেন অশান্তি?
অসমে অশান্তির কারণ মূলত ভাষা৷ অসমীয়রা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের বিরোধী৷ তাঁদের কাছে বাংলাদেশিদের ধর্মীয় বিভেদ গুরুত্বহীন৷ মুসলমান বা হিন্দু – কোনও বাংলাদেশিকেই অসমে অনুপ্রবেশ করতে দিতে চায় না অসমবাসী৷ তাঁদের মতে অসমে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশীরা৷ ত্রিপুরার একটি অংশের মানুষও এই বিলের বিরোধী৷
৩. অসমের বরাক উপত্যকার কী পরিস্থিতি?
বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষাভাষিরা নাগরিকত্ব বিলকে সংশোধন করছে৷ কারণ তারা মনে করে ওই বিল তাঁদের বাঁচাবে৷ কারণ জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) -এর ফলে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন৷
৪. অসমে বাংলাভাষী মুসলমানরা কী বলছেন?
অসমে বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানদের ৮টি জেলা রয়েছে৷ মধ্য এবং পশ্চিম অসমের ওই জেলাগুলি নাগরিকত্ব বিলের বিপক্ষে৷ অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, অগপ এবং আসুর সঙ্গে এই বিলের বিরোধিতী করছে৷
৫. অসমীয় ভাষায় কথা বলা মুসলমান রা কী বলছেন?
তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য হয়ে গিয়েছে৷ তারা যেকোনও ধর্মের মানুষের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে৷
৬. বিজেপি কী করতে চায়?
ভাষাগত সমস্য দূর করতে বিজেপি আর্টিকেল ৩৭১ প্রয়োগ করতে চাইছে৷ সঙ্গে অসম চুক্তির ৬ নম্বর ক্লসও লাগু করা হবে৷ কী আছে অসম চুক্তির ৬ নম্বর ক্লসে? অসমীয় ভাষায় কথা বলা মানুষের সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং ভাষাগত সংরক্ষিত হবে৷ প্রাধান্য পাবে৷
৭.এনআরসি-এর জন্য বাংলাদেশ থেকে চলে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম থেকে কী চলে যেতে হবে? আবার ভিটেমাটি ছাড়া হবেন তাঁরা?
২০১৪ সালে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল উদ্বাস্তু হিন্দুদের আশ্রয়স্থল ভারত অবং ক্ষমতায় এসে তিনি সে ব্যবস্থাই করবেন৷ কথামতো কাজও করেছেন তিনি৷ পাসপোর্ট আইন, বিদেশি আইন বা ফরেনার্স অ্যাক্টোর সংশোধন করেছেন৷ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ – এর মধ্যে যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে এসেছেন তারা এই দেশে আইনি বসবাসের অধিকারি হয়েছেন৷
৮. বাংলাদেশী মুসলমানরা ভারতে কেন উদ্বাস্তু স্বীকৃতি পাবেন না?
রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তুর সঙ্গা ঠিক কী, জানা প্রয়োজন৷ বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র৷ সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে৷ রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তুর সঙ্গা অনুযায়ী তাঁদের উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় দেওয়াটাই আইন৷ কারণ, উদ্বাস্তুর সঙ্গায় বলা রয়েছে, ‘‘যে ব্যক্তি জাতি, ধর্ম, নাগরিকত্ব, সামাজিক বা ধর্মীয় সংস্থার জন্য অত্যাচারিত হচ্ছেন বা হওয়ার আশঙ্কায় দেশ ছেড়েছেন তাঁরাই উদ্বাস্তু৷ সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক কারণে চলে আসা কাউকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সঙ্গায় উদ্বাস্তু গণ্য করা হয় না৷ কেবলমাত্র গরীব বলেই অন্য দেশে গিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা এবং রোজগার করার অধিকার জন্মায় না৷